কোনো মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি কীভাবে বণ্টিত হবে, সেটি মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে বিশদভাবে বলা আছে। আইনানুসারে সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টিত হওয়ার আগে প্রথমত, মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকলে সেখান থেকে তার দাফন-কাফনের যাবতীয় খরচ মেটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো ধার-দেনা করে থাকেন তবে তা তার সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা পুরোপুরি পরিশোধ করে দিতে হবে। মোট কথা স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহর স্বামী মৃত অথবা জীবিত যাই থাকুক না কেন তা স্বামীর সম্পত্তি থেকে সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দিতে হবে মুসলিম আইন অনুযায়ী।
চতুর্থত, মৃত ব্যক্তি কোনো দান কিংবা উইল করে গেলে তা প্রাপককে দিয়ে দিতে হবে। উলি্লখিত সব কাজ সম্পন্ন করার পর মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীদের কে কতটুকু অংশ পাবেন এবং উত্তরাধিকারী না থাকলে সম্পত্তি কীভাবে বণ্টিত হবে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
স্বামীর অংশ :
প্রথমেই স্বামীর অংশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। স্বামী কখনই তার মৃত স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন না। স্বামী দুভাবে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকেন। (ক) মৃত স্ত্রীর কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবেন। (খ) মৃত স্ত্রীর কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে স্বামী তার স্ত্রীর সম্পত্তির ১/২ অংশ পাবেন।
স্ত্রীর অংশ :
বিধবা স্ত্রীও কোনোভাবেই তার স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। স্ত্রীও দুভাবে তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি পেয়ে থাকেন। (ক) মৃত স্বামীর কোনো সন্তান বা তাদের পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবেন। (খ) যদি মৃত স্বামীর কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে তবে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবেন। স্ত্রী একাধিক হলেও সবাই মিলে ১/৪ অংশ সমানভাবে বণ্টন করে নেবেন।
বাবার অংশ :
বাবা তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। (ক) যদি মৃত সন্তানের পুত্র, পুত্রের পুত্র বা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যতই নিচে হোক না কেন কোনো পুত্রের অস্তিত্ব থাকে, তবে মৃত সন্তানের পিতা পাবেন তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ। (খ) যদি মৃত সন্তানের কেবল কন্যাসন্তান বা তার পুত্রের কন্যাসন্তান থাকলে তবে পিতা তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন।
এই ক্ষেত্রে কন্যাদের ও অন্যদের দেয়ার পর অবশিষ্ট যে সম্পত্তি থাকবে তাও পিতা পাবেন। (গ) আর যদি মৃত সন্তানের কোনো পুত্র-কন্যা বা পুত্রের সন্তান কিছুই না থাকে তবে বাকি অংশীদারদের তাদের অংশ অনুযায়ী অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট যা থাকবে তার সবটুকুই বাবা পাবেন। তবে মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান ও বাবা কেউ না থাকলে তার সম্পত্তি তার জীবিত ভাই বা ভাইয়েরা পাবেন। আবার ভাই না থাকলে তার ভাইয়ের সন্তানরা পাবেন।
মায়ের অংশ :
মাও তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে অংশ পেয়ে থাকেন। (ক) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি (যত নিচেই হোক) থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই-বোন থাকলে তবে মা ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন। (খ) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে এবং যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) পাবেন। (গ) কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুজন ভাই-বোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) মাতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।
পুত্রসন্তানের অংশ :
মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলেরা সব ক্ষেত্রেই সম্পত্তি পেয়ে থাকে। যে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ছেলে ও মেয়ে রয়েছে সেই ক্ষেত্রে ছেলে বা ছেলেরা, মেয়ে বা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে পিতা-মাতা ও স্বামী-স্ত্রী নির্দিষ্ট সম্পত্তি পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলেমেয়ের মধ্যে বণ্টন করা হবে। তবে মেয়ে না থাকলে অংশীদারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে বাকি সম্পূর্ণ সম্পত্তি ছেলে বা ছেলেরাই পাবে।
কন্যাসন্তানের অংশ :
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কন্যারা তিনভাবে পিতা-মাতার সম্পত্তি পেতে পারে। (ক) একমাত্র কন্যা হলে তিনি রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ বা (১/২) অংশ পাবে। (খ) একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাবে তিন ভাগের দুই ভাগ বা (২/৩) অংশ পাবে। (গ) যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে।
যা হোক কন্যা কখনো পিতা-মাতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না। দাদার আগে পিতা মারা গেলে পিতা জীবিত থাকলে যে পরিমাণ উত্তরাধিকার সম্পত্তি পেতেন তা তার (পিতার) মৃত্যুর পরও তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। ১৯৬১ সালের আগে এই নিয়ম ছিল না। পরে একটি আইন পাস করে এই নিয়ম চালু করা হয়। কারণ এতিমরা যাতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই সম্পর্কেও ইসলামে নির্দেশ দেয়া আছে।
আবার মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোনো সন্তানকে ত্যাজ্য বলে ধরা হয় না। ফলে সম্পত্তি থেকে তাকেও বঞ্চিত করা যায় না। তবে কোনো ব্যক্তি রেজিস্ট্রিকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করে গেলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করে গেলে ওই সন্তান আর সম্পত্তি পাবে না।
সৎ বাবা বা সৎ মায়ের সম্পত্তি সৎ ছেলেমেয়ে পায় না। একইভাবে সৎ ছেলেমেয়ের সম্পত্তিও সৎ বাবা বা সৎ মা পায় না। কেউ কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারী তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে কেউ কারও সম্পত্তি পাবে না।
জারজ সন্তান তার মা ও মায়ের আত্মীয়দের থেকে সম্পত্তি বণ্টনের সাধারণ নিয়মানুযায়ী প্রাপ্য পাবে (মুসলিম হানাফি আইন অনুসারে)। মৃত ব্যক্তির কোনো উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তা তিনি জীবিতকালে কাউকে দেয়ার ব্যবস্থা না করে গেলে সরকার তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে।